জার্মানিতে প্রথম দিনগুলি ২

আমি বললাম টিকেটের তো কোন সিস্টেম দেখলাম না। আমার কেমন যেন শিরশিরানি অনুভূতি তৈরি হল, মুন্নি সাহা থাকলে আমার অনুভূতি জিজ্ঞাসা করার এই সুবর্ন সুযোগ কখনোই হাতছাড়া করতো না এ বিষয়ে আমি ১০০% নিশ্চিত! আমি উল্টা উনারে ঝাড়ি লাগাই বললাম আপনি তো বইলা দেন নাই টিকিট কেমনে কাটে, আমিতো ভাবলাম বাসে কেউ ভাড়া তুলতে আসবে। ঠিকই তো আছে দেশে তো এমনেই টাকা তুলে আমার কি দোষ বলেন? পুরো BSAAG এর সব আর্টিকেল মোটামুটি পড়ে গিয়েছি কোথাও এরকম কিছু পাই নাই মাথায়ও আসে নাই, যাইহোক ইমদাদুল ভাই বললো এখনি ড্রাইভারের কাছে যান। ১৫ ঘন্টার মত জার্নি করে এসে বাসের নীচতলায় লাগেজ রেখে আরাম করে উপর তলায় বসে ছিলাম, হন্তদন্ত হয়ে নীচে নেমে ড্রাইভারের কাছে গেলাম

 

আগের পর্বগুলি

জার্মানীতে প্রথম দিনগুলি পর্ব ১

 

আমি: “Hi, I need a ticket for Darmstadt”

ড্রাইভার: “Darmstadt?”

আমি: “Yah!”

ড্রাইভার: (মুখের দিকে তাকায় থেকে) “Eine?”

আরও কি কি যেন বললো সব মাথার ১৩ হাত উপর দিয়ে গেল। হঠাত মনে পরলো Duolingo তে শিখছিলাম Eine মানে ১। কম্পাইলেশন সফল হওয়ার সাথে সাথে কইলাম Yah। কিছু খুচরা ইউরো দেশে থেকে নিয়ে আসছিলাম দিলাম ৮.৭০ ইউরো দাম নিলো টাকাটুকা গোনা বাদ দিয়া চুপচাপ উপ্রে গিয়ে বসে পরলাম। ভাই আগেই বলে দিয়েছে কোথায় নামতে হবে। আধাঘন্টা পর বাসে ঘোষনা করলো Next Stop Luisenplatz Zentalar Umstieg। লুইজেনপ্লাটস শুনেই নেমে গেলাম ১-২ ডিগ্রী তাপমাত্রার মধ্যে। এয়ারপোর্টে এতক্ষন শীতের কথা ওভাবে মনে ছিল না কিন্তু এখানে এসে একটু ধরতে লাগলো। বাস থেকে নেমেই দেখি ইমদাদুল ভাই দাড়ায় আছে সাথে একটা জার্মান পোলা নাম Hannes। পরিচয় করায় দিলো উনি নাকি আমার অফিসের কলিগ।

আমি চারদিকে তাকায় তুকায় দেখতে লাগলাম কিন্তু কেউ ইংরেজীতে কথা বলে না বিষয়টা মাথায় গেল না। এখানে কেমনে বসবাস করবো সেটা নিয়েও চিন্তিত হয়ে পরলাম। ভাই কিছু ফ্রোজেন পিজা আর ট্রান্সপোর্ট টিকেট কেটে উনার ভাইয়ের বাসায় পৌছায় দিয়ে আসলো ওখানেই আমার আপাতত থাকার যায়গা করা হয়েছে। বাসা না পাওয়া পর্যন্ত শেল্টার।

ভাই অফিসে চলে গেল আমি শীতের তেব্রতায় কুচকানো শুরু করলাম। দেশে থেকে কেনা আমার ৭ হাজার টাকা দামের জ্যাকেট হার মেনে দেশে ফেরত যেতে চাইলো। আমি আপাতত একগাদা জামাকাপর নীচে পরে চেষ্টা করতে লাগলাম টিকে থাকার।

বিকেলে হাটতে বের হলাম, মোবাইলে সিম নাই, ইন্টারনেট নাই, পাবলিক ইংরেজী জানে না বেশিরভাগই, রাস্তাঘাট চিনি না টেনশনে বেশিদুর যাইতে পারলাম না। বার বার চিন্তা করছি বাসার রাস্তা যদি না চিনি তাহলে খারাপ কি হতে পারে। Am Karlshof নামটা বিরবির করতে বলতে বলতে ঘুরতে লাগলাম যেন ভুলে না যাই আমি কই থাকি।

asifsaho in Am Karlshof Studentenwerk

বিকেলে ইমদাদুল ভাই ফোন দিয়া কইলো লুইজেন যাইতে, একসাথে ডিনার হবে। কইলাম বাসে কেমনে উঠবো? তারপর উনি বললো ঠিক ৭ (কাছাকাছি হবে) মিনিট পর বাস আসবে আমি যেন বাস স্টপেজে চলে যাই। ইন্সট্রাকশনমত হাজির হয়ে দেখি টাইমমত বাস হাজির। টাইমমত বাস কেমনে আসে বিষয়টা মাথায় ঢুকলো না আর উনিই বা কেমনে এত ঠিকঠাক বলে দিল। সবতো আর মুখস্ত থাকে না। পরে জানলাম মোবাইল এপে নাকি এগুলা দেখা যায়।

আমিতো তাকে প্রশ্ন করতে করতে অলরেডি মাথা খারাপ করে ফেললাম তারপর একটা থাই রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। খাওয়া দাওয়া করে বাসায় ব্যাক।

কয়দিনে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটল না কিন্তু কিছু অভিজ্ঞতা হল। যেমন কাউকে ইংরেজী বলতে হলে এমন একটা ভাব নিয়ে বলতে হবে যেন আমি নিজেই ইংরেজী পারি না এবং ধীরে সুস্থে তাতে সম্ভাবনা আছে কাজ হবার। শীতের তীব্রতায় যেহেতু আমি বরাবরই অস্থির হয়ে যাই সেহেতু যখন বেশি ঠান্ডা লাগবে একটা মার্কেটে ১০ মিনিট থেকে আবার বের হলে কিছুক্ষন ভালভাবে টিকে থাকা যায়। পুরো শীতকালটাই আমি এভাবে পার করেছি।

এতো গেল আসার গল্প, অফিসে জয়েন করলাম তারপর জানলাম অফিস নাকি লোকাল ফুডবল টিমকে স্পন্সর করেছে আমি চাইলে খেলা দেখতে যাইতে পারি, সেখানে সবার জন্য VIP গ্যালারিতে জায়গা বরাদ্ধ নেয়া আছে। এরকম সুযোগ কি আর কেউ মিস করে বলেন আমি মেইলের রিপ্লাই দিয়া দিলাম “Count me in!”। নীচে কিছু ফুডবল খেলার ছবি দিলাম, পুরাই ফিফা এক্সপেরিয়েন্স দারুন জমলো কিন্তু সবাই বিয়ার টিয়ার খাইলো আমি আপাতত শাকসবজি খেয়ে আমার বসের লগে পকপক করলাম।

ধর্মীয় কারনে বিয়ার বা এলকোহলিক ড্রিংস পান করি না জানার পর এটা সবার কাছেই কৌতুহল জোগালো। পরবর্তীতে মনেহয় অফিসের অর্ধেক লোক আমাকে জিজ্ঞাসা করছে আমি ঠিক কেন বিয়ার খাই না। জার্মানদের কাছে কেউ যদি বলে সে বিয়ার পছন্দ করে না তাহলে তার সাথে বন্ধুত্ব হওয়া তো দুরের কথা শত্রুই হয়ে যেতে পারে। আমাকে যে কতজন বুঝাইছে এইটা কত ভাল জিনিস সে কথা আর নাইবা বললাম।

আমিতো বউরে আনার জন্য পাগল হয়ে গেলাম, এখানে সবকিছু চেইনের মত, বউ আনতে গেলে তার জন্য ভিসা লাগবে, ভিসা পেতে লাগলে আমার রেসিডেন্স পারমিট লাগবে, রেসিডেন্স পারমিট পেতে এড্রেস রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, এড্রেস রেজিস্টেশন করতে গেলে বাসা পাইতে হবে। আমি সবকিছুর শুরুতে এসে বাসা পেতে কঠিন একটা পরিস্থিতিতে পরলাম। শতশত বাসার এডে এপ্লাই করলাম, কিন্তু কোন রিপ্লাই নাই অবশেষে একজন রিপ্লাই দিয়ে বললো বাসা দেখতে যাইতে। কপাল ভাল যে মহিলা ইংরেজীতে কথা বলে।ইমদাদুল ভাইকে বললাম যাবেন নাকি আমার সাথে, উনি উল্টা আমাকে পাম দিয়ে দিল আপনি তো বাসের সিস্টেম জানেনই এটা কোন সমস্যা হল নাকি ঘুরে আসেন। পাম তেল খেয়ে নিজের উপরে তীব্র কনফিডেন্স ফিল করতে লাগলাম। ততদিনে আমি এ্যাপে বাসের সময়সূচী দেখা শিখে গেছি। হাতে সময় নিয়ে -৬ ডিগ্রীর মধ্যে ট্রামে উঠে পরলাম। ট্রাম থেকে নেমে দেখি পরবর্তী বাস অপেক্ষা করছে। উঠে বসে পরলাম গুগল ম্যাপ নিয়ে। বাস যাচ্ছে যাচ্ছে কিন্তু আমি গুগল ম্যাপে কিছুক্ষন পর খেই হারিয়ে ফেললাম। কেন যেন খুজে পাচ্ছি না লোকেশন। আবার টেনশনে পরলাম। ইতিমধ্যে বাসের সবাই নেমে গেছে একজন বৃদ্ধ বসে আছে শুধু। ড্রাইভারের কাছে গিয়ে বললাম উনার সবকিছু মাথার উপর দিয়ে গেল জার্মান ভাষায় কি সব যেন জিগাইলো, কিছুক্ষন পর দেখি বাস একটা বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে হরিন জাম্প দেয়ার সাইন দেখতে পারলাম। পকেট থেকে ফোন বের করে বুঝার চেষ্টা করলাম কই আছি। বাসা পাওয়ার এই সুযোগ হাতছাড়া করলে কেমনে কি হবে সেটার সাত পাচ চিন্তা করতে করতে দেখি ফোনের ম্যাপ কাজ করতেছেনা। ভাল করে দেখি ফোনের নেটওয়ার্ক নাই এদিকে আশেপাশে মাত্র দুজন মানুষ যারা ইংরেজী জানে না! কই আসলাম তাই জানি না এত রাতে এখন বাসা দেখবো কেমনে আর বাড়ি যাবো কেমনে এই টেনশনে আমি হালকা ঘেমে গেলাম, আবার মুন্নি সাহার কথা মনে পরলো 🙁

পরের পর্বগুলো এখানে থেকে পরে আসতে পারেন

জার্মানিতে প্রথম দিনগুলি পর্ব ৩