ঘটনাটা খুবই বিব্রবকর, এয়ারপ্লেন মুড বন্ধ করে চালু করেও সুবিধা করতে পারলাম না, লাইকামোবাইলের বাপ দাদার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে দেখলাম একটু ইন্টারনেট পেলাম এবং সাথে সাথে মিশুর (বউ) মেসেজ পেলাম, আমি কেন এতক্ষন ধরে যোগাযোগ করতেছি না তার বিস্তারিত অভিযোগপত্র! আমি যে কি বিপদে আছি সেটা এখন বুঝানোর মত টাইমও নাই। কিন্তু ও কি আর এগুলা বুঝে? এমন একটা দেশে আসছি যাদের ভাষা আমি বুঝি না আমার ভাষা তারা বুঝে না এটা যে কি পরিমান বিপদ সেটা এমন পরিস্থিতিতে না পরলে বুঝা সম্ভব না।
যারা আগের পর্বগুলো এখান থেকে পরে আসতে পারেন
জার্মানিতে প্রথম দিনগুলি পর্ব ১
জার্মানিতে প্রথম দিনগুলি পর্ব ২
আমি আপাতত একটা সিদ্ধান্ত নিলাম, বাস থেকে নেমে যাবো পরবর্তী স্টপেজে এবং উল্টা দিকে হাঁটা ধরবো যা আছে জীবনে, যখন একটু ইন্টারনেট পাবো তখন দেখে নিবো ম্যাপটা ভাল করে, যেমনে হোক পৌছাবোই একভাবে। পরবর্তী স্টপেজে নেমে যাচ্ছি এমন সময় ড্রাইভার ডাক দিলো বললো আমি যেন না বের হই বসে থাকি, বুজলাম সে সাহায্য করতে আগ্রহী তো চুপচাপ বসে থাকলাম। ওকেও ম্যাপ দেখাতে ব্যার্থ হচ্ছি বার বার ইন্টারনেট না থাকায়। আপাতত সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে যোগাযোগ কোনরকমে চালায় যাচ্ছি। উনি এবার উনার ফোনে গুগল ট্রানস্লেটর চালু করে আমাকে দিলো আমি সেখানে বললাম তারপর ও সেটা জার্মানে শুনলো তারপর জার্মানে বললো আমি ইংরেজীতে শুনলাম। ওদিন একটা উপায় দিয়ে আল্লাহ বাঁচাইছে নাহলে অনেক কায়গা কসরত করতে হত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উল্লেখ্য রাস্তায় লোকজন একদমই নাই। লোকালয়ে বাস ঢুকার পর বাড়িঘর দেখি কিন্তু লোকজন দেখি না। এমনিতেই এদিকে লোকজনের বসবাস কম তারপর প্রচন্ড শীতে কেউ বাহিরে বের হওয়ার চিন্তাও করছে না। ড্রাইভারের সাথে এভাবে বেশকিছু কথা হল, তার মোবাইলে ম্যাপ চালু করে সে এড্রেস ভালমত এন্ট্রি দিয়ে আমাকে যায়গামত নামায় দিয়ে গেল। আমার ইন্টারনেটের অবস্থা খারাপ তাই কোনরকমে একটা ধন্যবাদ এবং প্রসংসাজরিত মেসেজ টাইপ করে জার্মানে অনুবাদ করে ওকে দেখাইলাম ও খুশি হল। তারপর নেমে গেলাম।
হাতে অনেক সময় নিয়ে বের হওয়াতে এতকিছুর পরও আধাঘন্টা আগেই যায়গামত উপস্থিত হলাম। বাড়ীয়ালীকে ফোন দিয়ে জানালাইম। সে পাক্কা ১০ মিনিট দেরীতে একটা গাড়ি নিয়ে হালকা ড্রিফট করে উপস্থিত হয়ে গেল। জার্মানরাও যে দেরী করে উপস্থিত হয় সেটা জানতে পেরে ভাল লাগলো ফিলস লাইক “We are not alone!” 😀
বাসা দেখে ভাড়া শুনে মন খারাপ হয়ে গেল, ভাড়া সব মিলায় ১০০০ ইউরো মত, এত টাকা বাসা ভাড়া দিলে খামু কি? জমামু কি? তারপর ২০০০ ইউরো এডভান্স আর ফার্নিচার নাই তাই সেগুলোও কিনতে হবে। এক কিচেন সেটের দামই তো ২০০০ ইউরো, পুরাতন ভাড়াটিয়া নাকি বিক্রি করে দিবে সেটাও ১২০০ ইউরো দাম। আমি আপাতত দেখেশুনে বাসায় চলে আসলাম মন খারাপ করে। জার্মানী আসছিই খালি হাতে এত টাকা কই পাবো, বাসা কবে নিবো আর ফ্যামিলি কবে আনবো এসব চিন্তা করতে করতে মুড অফ হয়ে থাকলো।
অফিসের পাশে ফেসবুকের কল্যানে আরেকটা বাসার খোজ পাইলাম, ভাড়া সব মিলায় ৮৮০ ইউরো, এখানে আরেক সমস্যা, এডভান্স সবমিলায় ৩৪০০ ইউরো, আবার মাইনকার চিপায় পরলাম! এবার আমার অফিসের বস আগায় আসলো, তার থেকে ১৭০০ ইউরো ধার আর ইমদাদুল ভাই থেকে ১২০০ ইউরো নিয়া এডভান্সটা রেডি করে ফেললাম। সমস্যা হল আরেক যায়গায় আমার নতুন বাসার কম্পানি আমার কাগজপাতি দেখে কইলো তোমারে বাসা দেওন যাইবো না তোমার ভিসা আছে আর দুই মাস। নাকের ডগায় বাসা পেয়ে এভাবে মিস হয়ে যাবে তাতো হয় না। আমি সুন্দর করে এক্সপ্লেইন করে মেইল দিলাম যে আমার ভিসা বাড়বে আর লাস্টে পাঞ্চলাইন “This is German the law” এই পাঞ্চলাইনটা এখানে খুবই কাজের। আইনকে সবাই মারাত্বক ভয় পায় এটার কারনও আছে, সবাই সরকার থেকে এত সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে যে ভুল করলে নিজেরই সমস্যা সাথে শাস্তি তো আছেই। এবার কাজ হল বাসা টাইমমত পেয়ে গেলাম।
বাসা পাওয়ার পর সিটি রেজিস্ট্রেশন করে কাগজপত্র প্রসেস শুরু করে দিলাম, যদিও এটা অনেক পেইনের কাজ ছিল, কেন যেন সবকিছুই আমার জন্য ঝামেলা হচ্ছিল।
এর মধ্যে একদিন অফিসের এক কলিগ Seif নাম তার সাথে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঘুরতে বের হয়েছি। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একটা বাসার সামনে দেখি কিছু থালাবাটি, মগ এরকম কিছু তৈজতপত্ররাখা। ওরে কইলাম এগুলা এখানে ফালাই রাখছে কেন? ও জানাইলো এগুলা ফ্রি হইতে পারে। আমরা আগায় গিয়া দেখতে যাওয়া মাত্র উপরে একজন বৃদ্ধ মহিলা আমাদের জার্মানে ভরভর করে কি যেন বলে গেল। আমরা দুজনেই চিন্তা করতেছি গালি টালি দিলো নাকি :/ কইলাম দেখ আমরা তো ইংরেজীতে কথা বলি। এবার মহিলা ইংরেজীতে আমাদের কইলো তোমাদের কি কোন ব্যাগ লাগবে? যা যা লাগে নিয়া যাও, যত নিবা আমি তত খুশি। বিষয়টা মাথায় ঢুকলো না এত সুন্দর সুন্দর কাচের প্লেট, গ্লাস, টোস্টার, ফ্রাই প্যান ফ্রিতে দিয়া দিতেছে কেন? মহিলা দ্রুত নীচে নেমে আসলো একগাদা ব্যাগ নিয়ে। আমাদের ভেতরে যাইতে কইলো। আমাদের ভেতরে নিয়ে গিয়ে দেখানো শুরু করলো আমরা কি কি ফ্রিতে নিতে পারি। বাসার দুইটা খাট, ম্যাট্রেস, দুইটা ফ্রিজ, কাপর শুকানোর মেশিন, আলমারি, চেয়ার, টেবিল, চাদর সবই দেখি দিয়া দেয়। আমরা পালানোর ধান্দা করতেছি কিন্তু উনি সবকিছুই আজকে আমাদের দিয়া দিবে এমন মক্কেল পাইলে কি কেউ ছাড়ে? এরকম একটা ভাব।
এবার আমাদের কৌতুহল থেকে প্রশ্ন করেই ফেললাম তুমি এগুলা ফ্রিতে দিয়া দিতেছ কেন? কয় সে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে থাকে কিন্তু বাসা চেঞ্জ করে ওনেক দুর যাবে এগুলা নিয়ে যাওয়া সম্ভব না, এগুলা নাকি রিসাইকেল করতেও প্রচুর খরচ দিতে হয় থার্ড পার্টি কম্পানিকে তাই ফ্রিতে বিলায় দেয়াটা বেশি লাভের। বারবার বলতে লাগলো “The more you will take, the more happy I will be”.
চকচকে তকতকে খাট আলমারী পছন্দ হলেও রাখার যায়গা নাই বিধায় ওটার আশা ছেড়ে দিতে হল, ছোটখাট ফ্রিজ দুইটা পছন্দ হল কিন্তু বাসায় কেমনে নিয়ে যাবো ভাবতেছিলাম, আমাকে অবাক করে দিয়ে মহিলা বললো তার গাড়িতে যা যা আটবে সে ফ্রিতে আমার বাসায় পৌছায় দিতে পারবে। আমার তো আবার মাথা খারাপ এই ফ্রি সার্ভিসের অফার শুনে।
কথায় কথায় শুনলাম এখানে দুটা বাসা নিয়ে তারা থাকে, উপর তলা আর নীচতলা। দুই বাসা কেন জিজ্ঞাসা করতেই শুনলাম তার বয়ফ্রেন্ড নাকি উপর তলায় থাকে সে নীচতলায়। আমাদের তো চক্ষু চড়কগাছ এইটা কেমন হল। সাইফ কৌতুহল দমায় রাখতে রাখতে আর সহ্য করতে পারলো না জিজ্ঞাসা করে বসলো তোমরা এক যায়গায় থাক না কেন? উত্তর দিল তার বয়ফ্রেন্ড নাকি তাকে সময় কম দিচ্ছে আর রাত করে বাসায় ফিরে তাই রাগ কইরা সে আলাদা থাকে। এরকম বৃদ্ধ মানুষের এমন অবস্থার কথা শুনে মনটাই খারাপ হয়ে গেল 🙁
আপাতত দুইটা ব্যাগ ভরে থালাবাটি, মগ, সিরামিকের হাঁড়ি নিয়ে রওনা হলাম। উনি জোর করে ফোন নম্বর দিয়া দিল আবার আসার আগে যেন জানিয়ে আসি।
কিছু ছবি দিয়ে আজকের মত শেষ করছি, আল্লাহ হাফেজ 🙂