জার্মানি যাওয়ার পর প্রথম দেশে ফেরা

এখানে আসার পর থেকে হেন কোন ঝামেলা নেই যেটার সম্মুখীন হই নাই। রাস্তায় বের হতেও চিন্তায় পরতে হত। কেউ কিছু বুঝে না। কোনভাবে এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠছিলাম কিন্তু মিশুর কান্নাকাটিতে কিছুতেই স্বাভাবিক থাকতে পারছিলাম না। দিন দিন মানসিক শক্তি হারিয়ে যাচ্ছিল। একেতো নতুন অফিস সেখানে তাদের মহান পুরাতন টেকনোলজি তারপর সেটা আবার আমি পারি না। সবকিছু মিলিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা।

আমরা এক অদ্ভুত জাতি, যখন মানুষ সমস্যায় থাকে তখন তাকে একটু মানসিক শক্তি দেয়া বাদ দিয়ে সবাই উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করতে থাকে। শহরের দিকে পরিস্থিতি কিছুটা ভাল হলেও মফস্বলের দিকে সমস্যা প্রকট। মিশুকে পাড়াপ্রতিবেশীরা এসে অদ্ভূত সব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। শুনলে মনেহয় তারা আমাদের কত কেয়ার করে, যত কেয়ার আমি দেশের বাইরে আসার পর উথলে পরতে লাগলো।

বাসা পাওয়া নিয়ে সমস্যা বহু কষ্টে সমাধান করে রেসিডেন্স পারমিটের এপ্লিকেশন মোটামুটি একটা অবস্থায় নিয়ে আসার পর যখন দেখছিলাম “দিল্লি বহুত দুর হ্যায়” তখন চিন্তা করছিলাম দেশে যাবো বেড়াতে তাতে একটু হলেও মানসিক চাপ কমবে। তখন মাস তিনেক হয়েছে জার্মানিতে আসা। অফিসে ছুটি নেয়াও ঝামেলা কারন আমার প্রবেশন পিরিয়ড ৬ মাস এর আগে এত বড় ছুটি নেয়া কঠিন। কিন্তু আমাকে বস এটা বলার চেষ্টা করলো না আপাতত। বস মনেহয় ভয়ে ছিল যে আমি দেশে গেলে আর আসবো না তাই বারবার বলতেছিল তোমার রেসিডেন্স পারমিট হয়ে গেলে তারপর দেশে যাও। এদিকে আমি গোঁ ধরে বসলাম অবশেষে বঙ্গদেশীয় ঘাঁড় ত্যাঁড়ামির কাছে জার্মান যুক্তি হেরে গেল, দু সপ্তাহের ছুটি পেয়ে গেলাম আমি বিমানের টিকেট কিনে ফেললাম।

এবার যাওয়ার প্রস্তুতি, আমি আপাতত কাউকেই জানালাম না যে দেশে যাচ্ছি, বাপ, মা, বউ, ভাই, বন্ধুবান্ধব কেউ জানে না। বিশাল একটা সারপ্রাইজের দেয়ার প্রস্তুতি নিলাম। মিশুর জন্য কেনাকাটা করা লাগবে এইজন্য ওর বড়বোনকে আর বোনের হাসবেন্ডকে জানালাম। টাকাটুকা পাঠাই দিলাম ওর আপু কেনাকাটা করে ফেললো আমি এখানে থেকে কোনটা কোনটা কিনবো রিমোটলি পছন্দ করতে থাকলাম।

রওনা দেয়ার আগের দিন, মিশু খুব করে বললো আমি যেন দেশে থেকে একবার ঘুরে আসি, আমি সোজা না করে দিলাম, চাইলেই যাওয়া যায় নাকি? এখন সম্ভব না জানাই দিলাম। মনে কষ্ট পাইলাম এত বড় মিথ্যা বলতে, পরদিনই যে বাড়ি যাচ্ছি সেটা যদি জানতো…

যার সাথে দিনে ৪-৫ বার কথা হয় তার সাথে ১৫ ঘন্টা কথা না বলে কিভাবে থাকা যায় সেটার একটা মাস্টারপ্ল্যান চিন্তা করতে থাকলাম নাহলে তো ধরা খেতে হবে। সেদিন ১৯ মে শনিবার। Der Airliner বাসটা আর যেন আসছেই না। জার্মান আর্টিকেলের নিয়ম অনুযায়ী পুংলিঙ্গের আগে Der এবং বিপরীতে Die এবং নিরপেক্ষ জিনিসের ক্ষেত্রে Das বসে। বাসের নামের আগে Der কেন বললো, বাসের আবার ছেলে মেয়ে কিসের এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে বাস এসে হাজির হল। যেহেতু তখনো নতুন তাই কোনটা এয়ারপোর্ট যাবে আর কোনটা এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র আসলো সেটা গুলিয়ে দাড়ায় থাকলাম। এবার দেখি আরেকটা বাস চলে আসলো অর্থাৎ একটা এয়ারপোর্ট থেকে আসছে আরেকটা যাবে। আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে ভাবতে থাকলাম করনীয় কি। কাউকে জিজ্ঞাসা করা একটা পেইন এজন্য আমি এই পথে যাই না সাধারনত। যে বাসে লোকজন বেশি উঠতেছে সেটাতে উঠে পরলাম। টিকেটের ওখানে গিয়ে বললাম “Eine ticket für Frankfurt flughafen bitte” যেহেতু কোন জ্ঞানবানী দিলো না ড্রাইভার সুতরাং আমি সঠিক বাসে উঠেছি। সিটে গিয়ে চুপচাপ বসে পরলাম, অতীতে টিকেট ছাড়া উঠে যে টেনশনে পরেছিলাম সেটার কথা ভেবে একটু হাসি পেয়ে গেল।

দেশে থেকে বাইরে আসা একটা অনুভূতি আর যাওয়া সে আরেক অনুভুতি এটা প্রকাশ করার মত না। কেমন যেন একটা অবস্থা তবে সবথেকে চিন্তার বিষয় হল ১৭ দিনের টোটাল ছুটি ফুরায় গেলে তখন কিভাবে ফেরত আসবো সেটার কথা ভেবে আরেকটা টেনশন বাগিয়ে নিয়ে বসলাম। প্রোগ্রামিং এ এরর হ্যান্ডেলিং ভালমত না করলে যেমন এপ্লিকেশন ব্রেক করে তেমনি লাইফে টেনশন হ্যান্ডেলিং ভালমত করা দরকার নাহলে জীবনে ছন্দপতন অনিবার্য। আমি অনেকদিন ধরেই বিষয়টা উন্নত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। পার্সন অব ইন্টারেস্টের জন এর মত করে বলতে হয় “I’m working on it”। বাস টার্মিনাল ১ এ এসে থামলো। সবাই নেমে যাচ্চে দেখে আবার চিন্তায় পরলাম টার্মিনাল ২ এ যাবে তো? পাশের জনের কাছে জিজ্ঞাসা করার রিস্কটা নিয়েই নিবো ভাবতেছি। ভয়ে ভয়ে জার্মান ব্যাটারে জিগাইলাম “Do you speak English?” আহ শান্তি! ব্যাটা আমার থেকে ভাল ইংরেজী বলে পুরা শিক্ষিত জার্মান। জানা গেল টার্মিনাল ২ তেও যাবে।

চেন ইন এবং সিকিউরিটি পার করে ওয়েটিং রুমে বসে বউরে ফোন দিয়া একটু কথাবার্তা বলা শুরু করলাম। এখন বউয়ের আবদার ক্যামেরা অন করতে হবে। আমার মিথ্যা কথা বলার হ্যান্ডেলার ফোবিয়ানের যাত্রী বইয়ের ভিলেন ম্যাঙ্গেল ক্বাসের শরীরে অবস্থিত রোবটের মত হ্যাং হয়ে গেল। এখানে ক্যামেরা অন করলেই বউ পেছনে অবারিত বিমানের সারি দেখে ফেলবে ওদিকে ওয়েটিং রুমেও লোকজন লাগেজ নিয়ে হাটাচলা করছে ধরা খেতে সময় লাগবে না।

অবশেষে দেয়ালের সাথে দাড়িয়ে কিছুক্ষন ভুংভাং মিথ্যা কথা বলে পরিস্থিতি ম্যানেজ করে ফেললাম। হোটেলে খেতে আসছি বলে আপাতত ঠান্ডা করা গেল। অফিসের কাজে আজকে জরুরী কারনে অন্য একটা শহরে যাচ্ছি এটা গিলাই দিলাম যদিও সে কিছুইতেই গিলতে চাচ্ছে না কারন অফিসের কাজে বাইরে যাবো কেন তারপর একটা আবার ছুটির দিনে।

এরপর আর তেমন কোন কথা নাই কুয়েত গিয়ে দৌড়ালাম লাউঞ্জের দিকে, ওয়াইফাই লাগবে, লাউঞ্জে বসে আবার একটু বউরে ম্যানেজ দিয়ে দিলাম। কপাল ভাল আর ক্যামেরা চালু করতে বলে নাই।

আবার প্লেনে উঠে পরলাম দেশে এসে নামার পর ইমিগ্রেশন শেষ করে আগাতেই দেখি কাস্টমসের অফিসার আমাকে দৌড়িয়ে ধরলো, জিজ্ঞাসা করলো কই থেকে আসছি, জার্মানি শুনে হতাশ হয়ে পরবর্তী মক্কেল ধরতে দৌড় দিল, পরে দেখি কুয়েতের এক যাত্রীকে ধরে ব্যাগ চেক করতেছে। বিষয়টা বুঝলাম না যে কুয়েতের যাত্রীদের কি সমস্যা। সকালের দিকে ঢাকাতে ল্যান্ড করে জিতুকে ফোন দিলাম। জিতু আমাকে ভালমতই চিনে জিগাইলাম ফ্রি আছে নাকি উত্তরে বলে “দেশে আসছো নাকি?” বুঝলাম ওকে চমকে দেয়াটা এত সোজা না। রবিবার ওর ছুটির দিন হলেও অফিস করতে হচ্ছে। ওর কেয়ারটেকারকে বলে দিলো আমি একটা উবার নিয়ে চলে গেলাম জিতুর বাসায়।

পাবনার উদ্দেশ্যে যাত্রা

কয়েকঘন্টা থেকে দুপুর আনুমানিক ২ টার ট্রেনে আমি আর মিশুর বোন পাবনার উদ্দেশ্যে রওনা হব এই প্ল্যানে আমরা বিমানবন্দর রেল স্টেশনে উপস্থিত হলাম। আমার আসার খবরে ওর বোনও আমার সাথে বাড়িতে যাচ্ছে। ট্রেন ঘন্টাখানেক লেট করলো। এদিকে মিশুর সাথে বিশাল ঝামেলা পেকে গেল। এতক্ষন ফোন দিচ্ছি না কারন হিসেবে বললাম অফিসে আছি পরে কথা বলবো। তারপর দেখি আমার সাথে আর ঠিকমত কথা বলে না। পরে বুঝলাম কিছু একটা ভূল হইছে। এখন শুনি আজকে রবিবার ছুটির দিন! এত কইরা বুঝাইলাম একটু জরুরী কাজে অফিসে আসছি কিন্তু বউ কিছুতেই মানে না। জার্মানরা ছুটির দিনে অফিসের দিকে ফিরেও তাকায় না এটা একসময় ওকে বুঝানো হইছে এই বুঝ এখন ভাঙ্গানো বিশাল কঠিন একটা কাজ সেটা হারে হারে টের পেতে লাগলাম।

ফোন দিয়ে একটু ঝাড়িঝুড়ি দিলাম কোন কাজ হল না, আমি চিন্তা করতেছি এদিকে অন্য জিনিস, ফোন দিলাম বাংলাদেশী নম্বর দিয়ে, রেলস্টেশনে আশেপাশে লোকজন বাংলায় কথা বলতেছে তারপরও আমার বউ টের পাচ্ছে না যে আমি দেশে আসছি অথচ অফিসে রবিবারে কেন গেছি সেটা নিয়ে মহাতুলকালাম। নারীর মন… ইউ নো ওয়াট আই মিন 😛

আপাতত কাউন্টার এটাক দেয়ার প্রস্তুতি নিলাম, ফোন মেসেঞ্জার অফ করে রেখে দিলাম, আপাতত এটার বিকল্প নাই, ট্রেনের মধ্যে নাহলে ধরা খেয়ে যাবো। ট্রেনের মধ্যে ওর বোন কথা বলতেছে সেম ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে (নাকি নয়েজ?) আমিও কথা বললে সন্দেহজনক ব্যাপার হয়ে যাবে। তীরে এসে শেষে তরী ডুবে যাবে।

একটু পর পর একবার ইন্টারনেট চালু করে মেসেজ দেখে বুঝার চেষ্টা করলাম আবহাওয়া কি, বুঝলাম ঘটনা সুবিধার না, ফোন বন্ধ করে রাখার জন্য পরিস্থিতি উল্টা আরও খারাপ হইছে, আমার কিই বা করার আছে, এতদিন ধরে একটা সারপ্রাইজ দেয়ার চেষ্টা করতেছি সেটা কি আর নষ্ট হতে দেয়া যায় বলেন? আমি মেসেজ Seen করলাম না এবং উত্তরও দিলাম না।

মিশুর বোনের থেকে যা বুঝলাম, ওদিককার পরিস্থিতি ভাল না, রাগ করে বউ আমার না খেয়ে বসে আছে। কেউ তাকে বুঝাইতে পারতেছে না। কিছুক্ষন পর ফোনও অফ করে দিল। এদিকে আর মাত্র ১ ঘন্টার যাত্রা বাকি এখন কি আর করা, শশুরবাড়ি দিকে যেতে থাকলাম।

অবশেষে শশুরবাড়ির গেটে উপস্থিত আমরা, টান টান উত্তেজনা মাঠ অলরেডি বলের বাইরে চলে গেছে। বউরে ফোন দিলাম দেখি ফোন অফ, আমার প্লান ছিল ফোন দিয়ে বলবো আমার বন্ধু তন্ময় তোমাকে একটা প্যাকেট দেয়ার জন্য বাসার বাইরে দাড়িয়ে আছে ওটা নিয়ে আসো। কিন্তু ফোন তো ধরে না। অবশেষে প্লান বি, ওর বোনকে বললাম ভিতরে গিয়ে বলেন রুমের বাইরে গিয়ে যেন আমাকে একটু ফোন দেয়। নাহ আজকে আবহাওয়ার ১১ নম্বরের বিপদ সংকেত দেখা দিয়েছে কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। কি আর করা শেষে দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা সবার সামনে গিয়ে হাজির হলাম।

পরবর্তী ঘটনা কি হয়েছে তা জানার জন্য পরবর্তী পর্বের জন্য অপক্ষা করুন 😀

.

.

.

.

.

.

.

.

.

.

.

.

নাহ থাক আজকে আর অপেক্ষা না করাই, শেষে চাকরি থাকবে না 😛 মিশুর বোন অনেকদিন পর বাড়িতে আসছে প্রায় ৩ মাস পর, একারনে সবাই এমনিতেই এটা ওটা রান্না করে খুশি হয়ে আছে আমাকে দেখার পর সবাই পুরোপুরি ১১০০০ ভোল্টের একটা শক খাইলো। মিশু বিছানার উপরে দেখলাম গো ধরে বসে আছে আমাকে দেখে সবসময় তীব্র ভুতের আতঙ্কে থাকা মেয়েটা গগনবিদারী একটা চিৎকার দিল। আমি বলতে থাকলাম ভুত না আমি সত্যি সত্যিই আসছি। পাক্কা একমিনিট মাথাগুজে থাকার পর তারপর আমার বউয়ের জ্ঞান ফিরলো। সে এক মনমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা, কেউ বেশিদিন দেশের বাইরে থাকলে অবশ্যই বাড়ি যাবেন না বলে, এটা যে কত বড় একটা সারপ্রাইজ তা চোখের সামনে না ঘটলে কখনোই বুঝা সম্ভব না। পাগলামির দেখতে দেখতে অবশেষে শাশুরী আর মিশুর বড়বোন রুম থেকে চলেই গেল লজ্জা পেয়ে। আমি ওর জন্য কেনা জামাকাপর এবং গিফটগুলো খুলে দেখাইলাম ওর দেখলাম এগুলাতে কোন আগ্রহই নাই। আমি আসছি এটার খুশিতে এগুলা যতই দামী হোক না কেন মনে কোন দাগ কাটলো না। লাগেজ বন্ধ করে রেখে বলে চলেন আমরা আপনাদের বাসায় যাই। মনে মনে ভাবলাম তেলে এত টাকা দিয়ে কেনাকাটা কি লাভ হল 🙁

যাইহোক বিশাল খানাপিনা শেষে আমাদের বাসায় সামনে এসে মিশুকে দিয়ে বাসার সবাইকে ফোন দেয়ালাম এবং দ্রুত বাসার সামনে আসতে বলালাম আহ সে কি দৃশ্য, আকিববাবু তো চিল্লাপাল্লা শুরু করে দিল।

এলাকায় প্রতিক্রিয়া

শেষে আরেকটা ঘটনা বলেই দেই, এলাকার মানুষজন আমাকে দেখে মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানালো। একজন জিজ্ঞাসা করলো এত তারাতারি কেন আসছি বললাম বেড়াতে আসছি উনার বিষয়টা কিছুতেই মাথায় ঢুকলো না। তার কথা মানুষ সৌদি আরব, কাতার কুয়েত থেকে মানুষ দু বছরের আগে দেশে আসে না আমি ৩/৪ মাস পর কেমনে আসলাম! আমি রসিক মানুষ উনাকে একটা ধাঁধার মধ্যেই রেখে দিলাম। আরেকজন তো নাকি বলেই বসেছে আমাকে দিয়ে নাকি দেশের বাইরে থাকা সম্ভব না। আমি এখন এসব এনজয় করি, “They hate us because they ain’t us”

অবশেষে এখানেই গল্পের পরিসমাপ্তি, আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন 🙂