জার্মানিতে এসে আমার মত যারা কোনদিন উন্নত দেশগুলে যায় নি তাদের একটু খাবি খেতে হয়, রাস্তা পার হবার আগেও টেনশনে থাকতে হয় কিছু ভুল হল কিনা ভেবে। যাদের পরিচিত কেউ এখানে আছে তাদের এই সমস্যা কম, কয়েকদিনেই সবকিছু শিখে ফেলে কিন্তু যাদের পরিচিত নাই তাদের জন্য একটু সমস্যাই। এক্ষেত্রে আগেভাগে নিয়মকানুন কালচার সম্পর্কে জেনে আসতে পারলে ভাল তাতে নির্ভার থাকা যাবে। এসব কিছু বিষয় নিয়েই আজকের লেখা। যদি কোন পয়েন্ট বাদ পরে যায় তাহলে কমেন্টে জানানোর জন্য অনুরোধ থাকলো।
ময়লা/বর্জ যথাস্থানে ফেলা
জার্মানি বর্জ রিসাইকেল করে পুনরায় ব্যাবহার উপযোগী করে, এখানে একেক রকম ময়লা ফেলার ডাস্টবিন একেক রকম। নিজের তিনটি ডাস্টবিন শুধুমাত্র তিন রংয়ের কাঁচের বোতল ফেলার জন্য, বাম থেকে যথাক্রমে সাদা, সবুজ এবং বাদামী রংয়ের বোতল। মানুষ গাড়িতে করে কয়েক মাসের বোতল একবারে ড্রপ করে দিয়ে যায়। এরকমভাবে কাপর, মিক্সড ময়লা, কাগজ ফেলার জন্য আলাদা আলাদা করে বিন রয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে যেন একটা জিনিস আরেকটাতে ফেলে না দেয়া হয়। যেকোন প্রকার ব্যাটারি এবং ইলেকট্রনিক্সদ্রব্য এসব বাক্সে ফেলা নিশেধ। ব্যাটারী ফেলার জন্য সুপার শপগুলোতে আলাদা বাক্স দেখেছি এবং ইলেকট্রনিক্সদ্রব্য রিসাইকেল করার জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান আছে যদিও ডাস্টবিনের পাশে বিকল/পুরাতন ফ্রিজ, রেডিও, টেলিভিশন ফেলে রেখে যেতে দেখেছি।
ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম
সাধারন লোকাল বাসের টিকেট বুথ থেকে কেনা যায় কিন্তু বাসের ড্রাইভারের কাছে থেকেও নিতে পারবেন এতে ২০ সেন্ট খরচ বেশি হবে (যায়গা ভেদে কমবেশি হতে পারে) তবে, ট্রামের টিকেট ড্রাইভারের কাছে পাবেন না (এক্সেপশন থাকতে পারে) তাই আগে থেকে সংগ্রহ করতে হবে। কোথাও কোথাও টিকিট কেনার পর এক্টিভেট করতে হয় যেমন বার্লিনে। টিকেট বুথ থেকে কেনার পর বাসে/ট্রামে/U Bahn উঠে ভেতরে ছোট মেশিনে টিকেট ঢুকিয়ে দিলে তা এক্টিভেট হয়ে যাবে। টিকেট ছাড়া পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ধরা পরলে ৬০ ইউরো বা তার বেশি জরিমানা।
বাস, ট্রাম, UBahn (Underground Metro Rail) এর টাইমটেবল দেখার জন্য সবথেকে দারুন এপটা হল DB Navigator যেটা Deutsche Bahn কর্তৃপক্ষের। এখানে কোথায় থেকে কোথায় যাবেন তা এন্ট্রি দিলে বিস্তারিত বাস এবং সময়সূচি দেখতে পারবেন। ইউজার এক্সপেরিয়েন্স খুবই ভাল তাই একটু গুতোগুতি করলেই শিখে ফেলবেন। অনেক শহরে গুগল ম্যাপই বিস্তারিত সময়সূচী দেখায় তবে এটা সবখানে না। ফ্রাঙ্কফুর্টে আমি গুগল ম্যাপে গাড়ির বিস্তারিত না পেলেও বার্লিনে খুবই সঠিকভাবে পেয়েছি। এই এপ থেকে বিভিন্ন ট্রেন বাসের টিকেটও কিনতে পারবেন তবে সব শহরে এটা কাজ করে না। বার্লিনে সঠিকভাবে পেলেও ডার্মস্ট্যাডে এটা কাজ করে নি। ট্রেনের টিকেট অবশ্য সবসময়ই এই এপ থেকে কিনতে পারবেন। পেপাল এবং আন্তর্জাতিক ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করা যায় এপে।
এখানে ট্রেন স্পিডের উপর ভিত্তি করে ভাড়াও ভিন্ন। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট টিকেট দ্রুতগামী ট্রেনে গ্রহনযোগ্য নয়, দ্রুতগামী ট্রেনের নাম ICE
দূরে কোথাও যেতে চাইলে যত আগে সম্ভব টিকেট কনফার্ম করে রাখা উচিত এতে খরচ অনেক কম হবে। কম খরচে টিকিট কিনতে চাইলে DB Navigator এর মেনু থেকে Saver Fares অপশন সিলেক্ট করুন এবং সুবিধামত টিকেট পছন্দ করে কিনে নিন। এয়ারপোর্টে নামার পর যদি ট্রেনে উঠতে হয় তাহলে দেশে থেকেই টিকেট কিনে রাখতে পারেন। ট্রেনে কোন প্রিন্টেড টিকেট দেখানো বাধ্যতামুলক না, চেকার আসলে ফোনের বারকোড দেখালেই হবে ওরা ওদের PDA দিয়ে চেক করতে পারবে।
জার্মান বাসে/ট্রেনে/উবানে বাচ্চাদের ট্রলি, হুইল চেয়ার, বাইসাইকেল রাখার জন্য আলাদা জায়গা থাকে। এজন্য আলাদা কোন ভাড়া দিতে হয় না।
বাইসাইকেল
এখানে সাইকেল খুবই এক্সপেনসিভ বিশেষত ব্যাটারীচালিতগুলো, একটা সাইকেলের দাম ২০০০ ইউরো হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। চলতে গেলে বাইসাইকেল লাগবেই, আশেপাশের পুরাতন মার্কেট (Flohmarkt) থেকে একটা কিনে নিতে পারেন অথবা ফেসবুক মার্কেটপ্লেসেও নজর রাখতে পারেন কেউ বিক্রি করতে আগ্রহী কিনা। প্রায় সবখানেই সাইকেলের জন্য আলাদা লেন থাকে। সাইকেল লেনে সাইকেল চিন্হ থাকে। ট্রাফিক লাইট মেনে বুক ফুলিয়ে সাইকেল চালাবেন, আশেপাশে যত জোরেই গাড়ি চলুক না কেন কেউ আপনাকে সমস্যা করবে না। আমি বাইসাইকেল আর পথচারীদের সবথেকে বেশি প্রায়োরিটি পেতে দেখেছি রাস্তায়। যেখানে সাইকেল লেন নেই সেখানে রাস্তার ধার দিয়ে চালাতে পারেন অথবা ফুটপাতে চালানোর নিয়ম থাকলে সাইন দেখতে পাবেন।
ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র
ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্রের দাম এখানে অনেক বেশি, বাংলাদেশ থেকেও বেশি, তবে কিস্তিতে কেনার সুবিধা খুবই কমন। কম্পিউটার বা ফোন যদি কেনার দরকার হয় তাহলে দেশ থেকে কিনে আনা উচিত, কিস্তিতে কেনার অপশনটা ভাল হলেও ১-২ বছর ধরে একটা জিনিসের জন্য পে করা আমার কাছে খুবই পেইনফুল লাগে।
ইন্টারনেট এবং মোবাইল সার্ভিস
মোবাইল ইন্টারনেট খুবই খরুচে এক গিগার দাম ৬ ইউরো থেকে শুরু। তবে টকটাইম খুবই সস্তা। সবথকে ভাল মোবাইল সার্ভিস প্রভাইডার আমার কাছে মনেহয়েছে Alditalk. ৯ ইউরোতে ১.৫ গিগাবাইট ডাটা এবং আনলিমিটেড মিনিট সাথে থাকছে পুরো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ফ্রি রোমিং সুবিধা, অন্যান্যা দেশেও রোমিং সুবিধা পাবেন তবে খরচটা সামলানো সম্ভব না।
দেশে কথা বলার জন্য সরাসরি ফোন দেয়া খুবই ব্যয়বহুল, Aldi Talk থেকে দেশে ফোন দিলে প্রতি মিনিট ১ ইউরো বা তার বেশি চার্জ করে যা অনেক বেশি। এজন্য Rebtel এর মত VOIP এপ ব্যবহার করতে পারেন। এই লিংকটি আমার রেফারেল লিংক, এখান থেকে রেজিস্টার করলে আপনি এবং আমি উভয়ই ৫ ইউরো বোনাস ব্যালেন্স পাবো। এদের ফি খুবই কম, প্রতি মিনিট বাংলাদেশে খরচ ৩ সেন্টের মত।
গাড়ি এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স
পুরাতন গাড়ি এখানে খুবই সস্তা এবং নতুন গাড়িও বাংলাদেশের অর্ধেকেরও কম দাম। পুরো ইউরোপ থেকে লোকজন এখানে থেকে গাড়ি কিনতে আসে। পৃথিবীর স্বনামধন্য গাড়ি কম্পানিগুলোর একটা বড় অংশ জার্মানিতে। Mercedes-Benz, BMW, Volkswagen সহ আরও অনেক স্বনামধন্য গাড়ি নির্মাতা কম্পানিগুলো জার্মানির।
দেশে থেকে এসেই যদি গাড়ি চালাতে চান তাহলে দেশে থেকে International Driving Permit (IDP) নিয়ে আসতে পারেন এটা দিয়ে প্রথম ৬ মাস গাড়ি চালাতে পারবেন জার্মানিতে। এখানে গাড়ি রাস্তার ডান সাইড দিয়ে চলে এবং ট্রাফিকের নিয়মকানুন অনেক ভিন্ন প্রথম দিকে যদি একান্তই গাড়ি চালাতে চান তাহলে অবশ্যই এখানে কোন এক্সপার্টকে নিয়ে বের হবেন। অযথা দুর্ঘটনা কারও কাম্য নয়।
জার্মানীতে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে চাইলে আপনাকে প্রথমে একটা ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি হতে হবে। কিছু দেশের লাইসেন্স জার্মানীতে কোন পরীক্ষা দেয়া বাদেই ট্রান্সফার করা যায় যেমন USA লাইসেন্স। দেশে লাইসেন্স থেকে থাকলে ড্রাইভিং শেখার কাজটা একটু সহজ হবে। নিচে কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করছি।
- ড্রাইভিং স্কুল খুজে বের করে তাদের সাথে একটা কন্ট্রাক্ট সাইন করুন Fahrschule লিখে সার্চ দিলে কাছের স্কুলগুলোর খোজ পাবেন। ছোট শহরে ইংরেজী মাধ্যম স্কুল পাবেন না।
- অন্য দেশের লাইসেন্স থাকলে তাত্বিক ক্লাস করা বাধ্যতামুলক না তবে করাটা ভাল, প্র্যাকটিকেল ক্লাসও ইচ্ছামত করতে পারবেন যতটা হলে নিজেকে কনফিডেন্ট মনেহবে। নতুন শিক্ষার্থী হলে তাত্বিক ক্লাস করা বাধ্যতামুলক এবং মিনিমাম ১০ (AFAIR) ঘন্টার প্রাকটিকেল গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা নিতে হবে।
- First Aid কোর্স করতে হবে, ছুটির দিনে অনেকেই এসব কোর্স অফার করে এমনকি রেডক্রসেও এই কোর্স করতে পারেন।
- চোখ পরীক্ষা করতে হবে, অনেকে দেখেছি First Aid কোর্সের সাথে এটার সার্টিফিকেশনও দিয়ে দেয়।
- বর্তমান লাইসেন্স জার্মান ভাষায় অনুবাদ এবং সত্যায়িত করতে হবে যথাস্থান থেকে।
- সিটি সেন্টার সম্ভবত নাম ওখানে ছবি, পাসপোর্ট, এবং বাকি কাগজপত্র নিয়ে রেজিস্টার করে ফেলতে হবে। এটা ওদের BRTA এর মত। উল্লেখ্য এখানে কেউ ইংরেজী পারবে সেই আশা করা উচিত না ভাল হয় জার্মান জানে এমন কাউকে নিয়ে যেতে পারলে।
এসবের বিস্তারিত ড্রাইভিং স্কুল থেকে বলে দিবে, দরকারে ভালমত জিজ্ঞাসা করে নিন। জার্মান ভাষায় ড্রাইভিং স্কুল হলেও ওদের ইংরেজী ইন্সট্রাক্টর থাকে।
শীতকাল
শীত বেশি হলেও তেমন সমস্যা হয় না কারন আপনি সারাদিন বাইরে থাকবেন না, বাসাবাড়ি, মার্কেট, বাস, ট্রেন সবখানেই হিটিং সিস্টেম থাকে। হুট করে রাস্তাঘাটে ঠান্ডা হয়ে গেলে কোন একটা মার্কেটে ঢুকে রিচার্জ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে শীতের পোষাক খুবই গুরুত্বপূর্ন। দেশে থেকে খুব বেশি খরচ করে পোষাক না কেনাই ভাল কারন বেশিরভাগই এখানে এসে দেখবেন কাজ করবে না। বেটার কম দামের মধ্যে একটা কিনে নিয়ে আসুন তারপর এখানে থেকে একটা কিনে নিন। একটা মজার ফ্যাক্ট বলি, আমরা মনেকরি তুষারপাত মানে অনেক ঠান্ডা আসলে তা না, প্রচুর ঠান্ডার পর যখন তুষারপাত হয় তখন আসলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে যখন গরম বাতাস চলে আসে তখন তুষারপাত হয়। এটা জার্মানিতে না আসলে হয়তো জানাই হত না।
ভাষাজনিত সমস্যা
অনেক জার্মানরা ইংরেজী জানলেও অন্য কোন ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করে না, এদের সাথে মেশার প্রধান জিনিস হল ভাষা অনেক সময় অনেকেই রেগে যায় ইংরেজী শোনার পর, আমার এখনো এই দুর্ভাগ্য হয় নাই হোক চাইও না। ভাষার গুরুত্ব ওরা বরাবরই বজায় রাখে। ফরেনার অফিস/ব্যাংক থেকে মেইলও জার্মান ভাষায় আসে। গুগল ট্রানস্লেটরের উপরে যতই আস্থা থাকুক ভাষা কিছুটা শিখেই আশা উচিত। এটলিস্ট ১-১০০ এবং কমন কিছু কথাবার্তা যেমন, দাম জিজ্ঞাসা করা, বাসের টিকেট চাওয়া ইত্যাদি। ভাষাজনিত সমস্যা নিয়ে আমি একটি বিস্তারিত পোষ্ট লিখেছিলাম এখানে পাবেন।
রেডিও বিল
রেডিও শুনেন আর না শুনেন প্রতি মাসে বাসাপ্রতি থেকে ২০ ইউরোমত পে করতে হয়। এটা না দিলে মামলা করে দিবে, এড্রেস রেজিস্ট্রেশন করার পরই বাসায় চিঠি পাঠিয়ে দিবে। ওদের আপনার ব্যাংক একাউন্ট চার্জ করার পার্মিশন দিয়ে দিতে পারেন তাহলে মেনুয়ালী পে করতে হবে না। আমি ৪ মাস পর একবারে পে করেছিলাম তবে কোনভাবেই ৬ মাস অতিক্রান্ত হতে দেয়া যাবে না তাহলে কিন্তু সমস্যা।
রবিবার সব বন্ধ
রবিবার জার্মানী স্থবির হয়ে যায়, রাস্তাঘাট দোকানপাট সব নিরব নিস্তব্ধ। কেনাকাটা করার থাকলে আগেই করে রাখতে হবে এবং এদিন এরিয়েই জার্মানিতে আসা ভাল তাহলে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পেতে অনেক অপেক্ষা করতে হয়। সাধারনত যে বাস ১৫ মিনিট পর পর আসে রবিবারে তা ঘন্টায় একটা। যদি জরুরী ভিত্তিতে খাবারদাবার কেনার দরকার পরেই যায় তাহলে খোজ নিন কিছু দোকান ৭ দিনই খোলা থাকে। আমার এখানে Rewe নামে একটা সুপারশপ আছে যার Hauptbahnhof (Central Rail Station) এর শাখা রবিবারে খোলা থাকে।
পোষাক কেনাকাটা
ভাল জামাকাপরের দাম বাংলাদেশে যেমন এখানেও তেমন, এমনকি বাংলাদেশে তৈরি পোষাকগুলোও। দেশের কম্পানিগুলো যে প্রচুর লাভ রাখে সেটা এখানে এসে বুঝতে পেরেছি। ছাড়ে জামাকাপর কিনলে হাই কোয়ালিটি জামাকাপর নিউমার্কেটের দামে পাওয়া যায়। একটু ক্লাসি জিনিস পেতে C&A তে যেতে পারেন আর একটু সস্তায় পেতে Primark দেখতে পারেন। সব শহরে বা আশেপাশে এদুটি দোকানের শাখা পাবেন। এর মধ্যে Primark বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমানে তৈরি পোষাক আমদানি করে দামও নাগালের মধ্যে। ছাড়ে মাঝে মাঝে প্রচুর সস্তায় অফার করে জিনিসপত্র।