স্পেশাল সনোগ্রাফির তারিখ চলে আসলো। আমরা নাচতে নাচতে চলে গেলাম। গিয়েই অভ্যর্থনায় জানানো মাত্র কিছু জার্মান ফর্ম ধরায় দিয়ে পুরন করতে বললো। বলে রাখি জার্মানিতে আইন কানুন এত মেনে চলা হয় যে পেপারওয়ার্কের কথা শুনলে জার্মানরা পর্যন্ত মুড অফ করে ফেলে আর আমিতো কোন ছাড়। বছরখানেক আগে একটা আবেদন করতে করার জন্য আমার CTO এর সাহায্য নিয়েছিলাম সে পর্যন্ত বুঝতে পারছিল না কিছু জিনিস। বলে যে আমি এরকম কিছু আগে দেখি বা শুনি নাই। অথচ ওই আবেদন সেও অতীতে কয়েকবার করেছে।
আগের পর্বগুলি এখান থেকে পড়ে আসতে পারেন
যাহোক গুগল ট্রানস্লেটর চালু করে একটু একটু করে ফর্ম পুরন করলাম তারপর জমা দিতে গিয়ে বললাম একটু দেখে নিতে আমাদের ভুল হতে পারে। এখন জিজ্ঞাসা করলো বাচ্চা ত্রুটিপূর্ন হলে আমরা জানতে চাই কি না। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। গাইগুই করে বললাম জানতে চাই। পরে সনোগ্রাফি করার আগে ডাক্তার আবার জানতে চাইলো আমি হ্যা বলে আবার একটু ভয় পেলাম। কোন সমস্যা থাকলে তো মিশুর অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে তখন সমস্যা একটা থেকে দুটোয় গড়াবে। তারপর শুরু হল সনোগ্রাফী। ডাক্তার সাহেবান তার ইন্টার্ন এবং আমাদের সবকিছু খুটিয়ে খুটিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি বাচ্চার বাবা নাকি ইন্টার্ন তা বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। উনি একবার আমাকে ইংরেজীতে আবার তার ইন্টার্নকে জার্মান ভাষায় বুঝিয়ে বলছিলেন। ২০-৩০% মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে কারন এত মেডিকেল সম্পর্কিত শব্দ আগে কখনো শুনিই নাই।
কাজ শেষে আমাদের জানালো বাচ্চা সুস্থ সবল এবং খুব ভাল। বাচ্চার নরাচরা সাধারনের তুলনায় বেশি যেটা নাকি ভাল। আমার ইমেইল এড্রেস নিল এবং সেখানে বাচ্চার ভিডিও একটা রঙিন ছবি এবং কিছু সাদাকালো ছবি দিয়ে দিলো। আমরাও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
এবার আসল কাজের প্রস্তুতি নেয়া হাসপাতাল ঠিক করতে হবে। মিশুর রিকোয়ারমেন্ট মহিলা ডাক্তার লাগবে। না পেলে যদি গোঁ ধরে বসে তখন কি হবে সেটা ভাবতেই কেমন যেন লাগতেছে। এসব ব্যাপার তো আর জার্মানদের বোঝানো সম্ভব না। এখানে ছেলে গাইনি ডাক্তারও প্রচুর তাই বিষয়টা চিন্তায় ফেললো। আবার রেসিজমের একটা বিষয় আছে তাই সব হাসপাতাল পছন্দ না। দেখা গেল বউ যায় যায় ওরা আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে জার্মান পারি না কেন।
একজন ভাবী জানালো একটা হাসপাতালের কথা যেখানে কিনা মহিলা ডাক্তার প্রচুর। আমরা একদিন চলে গেলাম গিয়ে শুনি ওখানে নাকি পরবর্তী ৫ মাস পর্যন্ত বুক 😬 রীতিমত তব্দা খেয়ে গেলাম। জার্মানরা এত পরিকল্পনা করে সবকিছু করে যে হাসপাতালে পর্যন্ত বুক করে রাখে ৫-৬ মাস আগে থেকে। আরে অদ্ভুদ এখন কি করি। গ্রামেগঞ্জে তো আর যেতে পারতেছি না। একেতো বিদেশী ওদিকে আবার ভাষা পারি না।
অতীতে শারিটে দুবার গিয়েছিলাম জরুরী প্রয়োজনে ভাবলাম ওখানেই চেষ্টা করবো। সমস্যা হল ওরা এত সব জরুরী রুগী নিয়ে ব্যাস্ত থাকে তাতে দেখা যায় কোন সমস্যা না থাকলে ওরা সমস্যাযুক্ত রোগীটা রেখে সমস্যা ছাড়া রোগীকে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে অন্যকোথাও পাঠিয়ে দেয়। বার্লিনের এক আপুর ক্ষেত্রেই এমনটা হয়েছে। শুনেছি এখানে নাকি ৫ মাসের অপরিপক্ক বাচ্চাও আছে ইউকিউবেটরে। শারিটে পৃথিবীর মধ্যে Ranking এ ৫ নম্বরে আছে এবং জার্মানিতে সাইকোলজি আর মেডিসিনে যতজন নোবেল পেয়েছেন তার অর্ধেকের বেশি এখান থেকেই পেয়েছেন। এটা জার্মানির সবথেকে পুরাতন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ও। শারিটে গিয়ে শুনলাম ৩৩ সপ্তাহ না হলে নাকি তারা ডেলিভারি বিষয়ক এন্ট্রি নেয় না। ৩৩ সপ্তাহ পর ফোন দিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে সময়মত গিয়ে কাগজপত্র ঠিকঠাক করে আসলাম। কাগজপত্র ওখানে কিছু পুরন করে আসতে হল আবার প্রচুর ডকুমেন্ট দিলো সেগুলা পড়তে হবে, জানতে হবে এবং ফরম পুরন করে সাক্ষর করে নিয়ে যেতে হবে ডেলিভারীর দিন।
সময় যেন আর কাটে না….
শেষ মাস, আমরা ব্যাগ একটা রেডি করে রেখেছি মোটামুটি। মিশুর আম্মু চলে আসছে কিছু নাটকীয়তার পর। আমরা প্রসব ব্যাথার জন্য অপেক্ষা করছি। ১৯ তারিখ সম্ভাব্য তারিখ। গাইনী ডাক্তার বলে দিলো ১৯ তারিখে যদি ব্যাথা না উঠে তাহলে তার ওখানে যেতে। ব্যাথা একটু উঠলো কিন্তু সেরকম না। আমরা গাইনীর কাছে গেলাম। উল্লেখ্য আমাদের ডাক্তার খুবই ড্যাম কেয়ার টাইম। যাই বলি বেশিরভাগ সময়েই বলে এটা কোন সমস্যা না এখন এরকম হয় ইত্যাদি। আজকে একটু অস্থির দেখলাম। দেখে হাসপাতালে রেফার করে দিলেন। বিষয়টা আমাদের চিন্তায় ফেলে দিলো কোন সমস্যা নাতো? ওদিকে হাসপাতালে যাওয়ার প্রস্তুতি নাই এখন কিভাবে যাই। ডাক্তার বললো আচ্ছা বাসায় গিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে দুপুরের পর যেতে। উনার কথা শুনে বুঝলাম আজকেই কিছু একটা হতে যাচ্ছে। বাসায় এসে সব রেডি করে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলাম।
শারিটে তে গিয়ে বললাম যা যা হয়েছে এবং ডাক্তারের রেফারেন্স পেপার দিলাম। উনারা দেখে চেকআপ করে বললো বাড়ি যাও কিছুই হয় নাই। আমি বললাম আমাদের ডাক্তার যে বললো ব্যাথার ঔষধ দিয়ে হলেও নাকি আজকেই করবে। ডাক্তার বললো কিছুই লাগবে না এখনো দেরী আছে। ১০ মিনিটে ২ বার যদি ব্যাথা উঠে তাহলে নাকি হাসপাতালে আসতে হবে। মনটা খারাপ হয়ে গেল কত আশা করিয়া আসলুম! কি আর করা বাসায় চলে আসলাম। মিশুকে বলতেছি আজকে ১৯ তারিখ তো হল না, ২৬ তারিখ যদি স্বাধীনতা দিবসে হয় তাহলে ভালই হবে। একটা ঐতিহাসিক দিনে জন্মদিন কে না চায়।
মাঝে মাঝে রাতে ব্যাথা উঠে চলে যায়, আমরা সেরকম বিরক্ত। ওকে বাইরে হাঁহাহাঁটি করার পরামর্শ দিচ্ছি তাও যাচ্ছে না। এদিকে দেরী হলে কাটাকুটা করতে হতে পারে সেটা একদমই পছন্দ না। ২৬ তারিখ ভোর ৪টার দিকে মিশু ঘুম থেকে ডেকে তুললো। এবার ব্যাথার ধরন দেখে মনহল সময় হয়ে গেছে। নগদে জিনিসপত্র রেডি করে কিছু মুখে দিয়েই গাড়ি নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালে। মনে মনে তখন খুব টেনশন ১৯ তারিখে ডেলিভারী রুম বুক দেয়া ছিল কিন্তু যাচ্ছি ২৬ তারিখে। যদি রুম না থাকে তাহলে ওই আপুর মত পাঠাবে আরেকটা হাসপাতালে। কি একটা খিচুরী অবস্থা হয়ে যাবে!
হাসপাতালে এসে গাইনোকোলজি বিভাগে গিয়ে শুনি ভেতরে একজনের বেশী যেতে পারবে না, করোনা প্রটোকল। এইটা কোন কথা, আমার বউ তো ভাল ইংরেজী পারে না তারপর অসুস্থ। এখন এগুলার মানে কি 😕। ওদিকে আমাদের এক বন্ধুর ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে, সে সারারাত হাসপাতালের বাইরে রাস্তায় ঘুরোঘুরি করছে। আমাকে যে গাইনী বিভাগ পর্যন্ত এসে বসে থাকতে দিয়েছে এটাই তো অনেক এই সান্তনা দিয়ে বসে থাকলাম। আমাকে বাইরে বসিয়ে রেখে ওকে নিয়ে গেল। আই অ্যাম লাইক আঁতুরঘরের বাইরে বাংলা সিনেমার স্টাইলে পায়চারী করতে লাগলাম….