baby boy new born

আমার বাবা হওয়া, পর্ব – ২ 🐣

এখানকার মানুষজন অন্তসত্তা হলে বিষয়টাকে পাত্তাই দেয় না। সারাদিন কাজকর্ম এমনকি খেলাধুলাও করে। আমি প্রথমে যে অফিসে জয়েন করি সেখানে একজন সহকর্মীর বাচ্চা হল সে মহিলা তো আরেক কাঠি সরেস। বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগের দিনগুলোতে সে স্কেটিং করছে এমনকি আমাদের অফিসে বেড়াতেও আসলো কি যেন একটা অনুষ্ঠান হইছিল সেটাতে। তারপরদিন বাচ্চা হল আবার দেখি ১ দিনের বাচ্চা নিয়ে অফিসে বেড়াতে আসছে নাচতে নাচতে। জ্বি ঠিকই শুনেছেন বাচ্চা হবার পরদিন সে বুকে একটা কাপর দিয়ে বাচ্চা পেঁচিয়ে অফিসে আসছে বেড়াতে।

আগের পর্বটি এখান থেকে পড়ে আসতে পারেন

আমার বাবা হওয়া পর্ব – ১ 🐣

আমাদের ডাক্তারও বলে দিয়েছে প্রতিদিন ১ ঘন্টা হাঁটতে হবে। কোন মাফ নেই। পরিশ্রম না করলে নাকি বাচ্চা প্রাকৃতিকভাবে হবে না সাথে নানা জটিলতা সৃষ্টি হবে। এই জার্মানি থেকে যদি বাচ্চা “সি সেকশন” হয় তাহলে তো আর হয় না।

সমস্যা হল দেশী চিন্তাধারা নিয়ে। দেশে তো পেটে বাবু আসলে হবু মা বেডরেস্টে চলে যায় যেন সে রোগী। এই ধ্যান ধারনা ভাঙতে কিছু সময় গেল। এরপর তিন তলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠা এবং বাইরে হাঁটাহাটি হওয়া সবই একটু করে হতে লাগলো। আমরা দিন গুনি আবার একমাস পর পর ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। যদি একটু সনোগ্রাফি করে কুট্টুনি বাবুটাকে দেখায় সেই আশায় থাকি 🥰

চলে আসলো বাবু দেখার দিন, মহা উৎসাহে আমরা চলে গেলাম ডাক্তারখানায়। সনোগ্রাফি রুমে এবার মিশু নাচতে নাচতে ঢুকে গেল। বাবু দেখার এই সুযোগ তো আর প্রতিদিন আসে না। আমিও ক্যামেরা হাতে প্রস্তুত। পিচ্চি সেরকম দুষ্টু পেটের মধ্যে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। ডাক্তার সাহেবান অনেকক্ষন চেষ্টা করতেছে একটা ভাল ছবি নেয়ার কারন সে মেপে দেখবে কতখানি বড় হল কিন্তু পিচ্চি সে সুযোগই দেয় না। ডাক্তার বললো তোমার বাবু যেভাবে সাঁতার কাটতেছে তার ছবিই তুলতে পারছি না। অবশেষে কিছুক্ষন চেষ্টার পর ছবি তুলতে সক্ষম হলেন। অন্যান্য রুটিন পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ হলে আমরা বাসায় চলে আসলাম।

আবার একদিন দুদিন করে দিন গোনা কবে বাবু দেখতে যাবো! সময় যেন আর কাটে না! আমরা বাচ্চার সাপ্তাহিক পরিবর্তনের এই ভিডিওটা একটু একটু করে দেখি। বেশি দেখলে মজা নষ্ট হয়ে যাবে জন্য বেশি দেখতে দেয় না মিশু।

পরবর্তী একটা সাক্ষাতে ডাক্তার সাহেবান বললেন ২০ সপ্তাহ হলে নাকি একটা স্পেশাল সনোগ্রাফি করতে হয় যেটাতে বাচ্চার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের খুঁটিনাটি দেখা হয় কোন সমস্যা আছে কিনা বোঝার জন্য। এজন্য কোথায় যোগাযোগ করতে হবে তার বিস্তারিতও বুঝিয়ে দিলেন।

প্রতিবারই ডাক্তারকে বলি ছেলে না মেয়ে বলতে কিন্তু ডাক্তার সাহেবান ওই প্রশ্নের উত্তরই দেন না। বউয়ের ফাপর খেয়ে আমি এবার নাছোরবান্দা। না বললে খেলবোই না! পরে ডাক্তার সাহেবান বললেন ছেলে হবে। আসলে আমরা ছেলে হল দেখে কনফিউজ হয়ে গেলাম, আমাদের আসলে ছেলে মেয়ে দুটোই দরকার, যমজ হলেই বেশি ভাল হত মনেহল। যাহোক আলহামদুিল্লাহ বলে আপাতত একটাতেই খুশি থাকলাম। পরে বুঝেছিলাম যমজের হলে আসলেই কি কঠিন অবস্থা হত, একটা মানুষ করতেই ঘরের বাইরে একটু বের হতে পারি না!

পরে জেনেছিলাম জার্মান আইন অনুযায়ী আনুমানিক ~১৫ সপ্তাহের আগে এখানে ছেলে না মেয়ে বলা নিষেধ। যেন কেউ বাচ্চার লিংগ জেনে গর্ভপাত করতে আগ্রহী না হতে পারে। ৩ মাস পরে এমনিতেও গর্ভপাত নিষিদ্ধ। যদিও ৩ মাসের আগে গর্ভপাত করতে গেলেও অনেক দাপ্তরিক কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে যেতে হয় যেখানে সরকারী লোকজন বাচ্চার ভরনপোষনের জন্য অতিরিক্ত টাকার প্রস্তাব পর্যন্ত দেয়।

বাচ্চার বয়স আনুমানিক ৪ মাস হয়ে গিয়েছে। পেটের মধ্যে গুতাগুতি করে এখন। গড় হিসেবে সাধারন সময়ের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই গুতাগুতি শুরু করেছে। একদিন হঠাত কোন নরং চরং নাই। আগের দিন রাত থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত মিশু কোন খোঁজখবর পাচ্ছে না। কান্নাকাটি করে বালিশ ভিজিয়ে ফেলছে। সকালে মনেহয় মৃদু একটা লাথি দিয়েছে কিন্তু আমরা ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। ওদিন ছিল রবিবার তাই ডাক্তার নেই। জরুরী প্রয়োজনে যেতে হবে হাসপাতালে। আমি গাইগুই করতে করতে পরে মিশুর চাপে হাসপাতালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। Charité জার্মানির অন্যতম বড় মেডিকেল ইউনিভার্সিটি। সমগ্র জার্মানির যতজন মেডিকেলে নোবেল পেয়েছে তার অর্ধেক এখানে কর্মরত বা অধ্যায়নরত ছিল। এখানে পছন্দ করার কারন এখানে পরিবেশটা অনেক আন্তর্জাতিক। সবাই ইংরেজী বলে তাই দুরে হলেও এখানেই আগ্রহী ছিলাম।

হাসপাতালে এসে বললাম এই ঘটনা, পিচ্চি নড়াচড়া করতেছে না। দ্রুত ইনিশিয়াল চেক করতে নিয়ে গেল তখন মিশু জানালো এখন নাকি লাথি দিচ্ছে 😡 চেকআপেও দেখলো পিচ্চির হার্টবিট ঠিকই আছে আমরা চলে আসতে চাইলাম কিন্তু ধাত্রী/দাই/Midwife বললো না হবে না ডাক্তার দেখবেন তারপর। যেহেতু জরুরী নাই তাই জরুরী রুগীদের আগে দেখতে লাগলো ডাক্তার। অবশেষে ২ ঘন্টারও বেশি সময় পর সারে ৬ ফিট লম্বা ডাক্তার রুমে ঢুকতে বললেন। ও হ্যা এখানে ডাক্তার রুমে এসে ডেকে নিয়ে যায়, ডাক্তারের ফরমায়েশ খাটার জন্য চাকর বাকর নেই।

ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলো কি সমস্যা। আমরা বললাম বাচ্চা নড়াচড়া করতেছে না। বয়স দেখে ডাক্তার বললো এত ছোট বাচ্চার নড়াচড়া তো টের পাওয়ারই কথা না। আমরা মুখ চাওয়াচাওই করলাম তেলে এতদিন ধরে পেটে কি নড়াচড়া করে? ডাক্তার সনোগ্রাফি করে দেখতে চাইলো। পিচ্চি পেটের মধ্যে দিব্যি নাচানাচি করতেছে দেখে ভাবমত পিটাইতে মনে চাইলো। এগুলার কোন মানে হয়? 😡

কিছুক্ষন পর ডাক্তার বললো আচ্ছা তোমাদের বাচ্চাটা আসলে অনেক কম বয়সে অনেক নড়াচড়া করে এটা খুবই এক্সেপশনাল তোমরা চাইলে আমি শিক্ষানবিসদের একটু দেখাতে চাই। বোঝোই তো ওদের তো শিখতে হবে। যদিও ৩ ঘন্টা ধরে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছি তারপর পেটে ভাত নেই তারপরও এত ভাল সার্ভিসের পর রাজি না হওয়ার সুযোগ নাই। উনি কয়েকটা ছাত্রী নিয়ে পড়াশোনা করাতে বসে গেলেন, আরও একঘন্টা বা বেশীই হবে 😭। কোনটা বাচ্চার কি, পেটের মধ্যে পরিবেশ কেমন… চলতে থাকলো। সেশন শেষ হতেই রিপোর্ট নিয়ে দৌড়ে বাড়ি গিয়ে ভাত চড়াইলাম ।