প্রিয় জিনিসগুলোর মধ্যে আমার কম্পিউটার এবং বাইকই সবকিছু। সারাদিন কম্পিউটারে কাজ করে করে অথবা সারারাত ঘুমিয়েও যখন ক্লান্ত তখন বাইকটাই ছিল আমার বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। অনেক দিন রাতের ঘুম এবং কষ্ট উপেক্ষা করে জমানো টাকায় এটা কেনা। ইচ্ছে ছিল সারাদেশের প্রতিটি জেলা ঘুরবো এটা নিয়ে, কাজের ফাকে ফাকে একটু একটু করে সেটা হয়েও উঠছিল, বেশ কয়েকটি জেলা বাইক নিয়ে ঘোরার তালিকায় উঠেও এসেছিল, ঢাকা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, পাবনা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহসহ আরও বেশকিছু জেলা।
মুলত ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাজে ঝিনাইদহ যাওয়া, সরকারী কাজ, এই ঝামেলা সেই ঝামেলা করতে করতে জিনিসটা পেতে দেরী হয়ে গেল। তবে দিনগুলো ভালই কাটলো মামুন ভাইদের সাথে। মেহেদী (৮৩) ঝিনাইদহ যাওয়ার সময় আমার সাথেই ছিলেন। বাইকে যাওয়াটাও ভালই আনন্দের ছিল।
লাইসেন্স পেলাম এবার ঢাকা ফেরার পালা, আমার দেরী দেখে মেহেদী ভাই ২৩ তারিখে ঢাকা চলে গেল। ২৫ মার্চ সকাল আনুমানিক সারে দশটার দিকে আমি একাই ঢাকার উদ্দেশ্য বের হলাম, মাগুরাতে পার হয়ে এক্সেটলি ১৮ কিলোমিটার পরে (মাইলস্টোনের পাশে) একজন বৃদ্ধলোক বয়স আনুমানিক ৬৫-৭০ সাইকেল নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন, আমার স্পিড তখন ৭০-৮০ এর মধ্যে। অনেক দুর থেকে তার রাস্তা পার হওয়া দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল আমি উনার পজিশনে যেতে যেতে উনি রাস্তা পার হয়ে যাবেন কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম ছিল না, পুরোটাই একটা ইল্যুশনের মত, উনি সাইকেলটা ঠিক রোটেট করতে পারছিলেন না, সম্ভবত সাইকেলের অতিরিক্ত উচ্চতা, বয়সের ভাড়ে শক্তির কমতি কোন একটা কারনে উনি হাইওয়ের ৫০% যায়গা দখল ছিলেন, প্রথমে কোনরকম সমস্যা মনে না হলেও উনার আর আমার দুরত্ব যখন অনেক কমে আসলো তখন আমার কোন উপায় থাকলো না তাকে আঘাত করা ছাড়া। সময় এতটাই কম তখন যে বাইক ডানে সাইড করা যাচ্ছিল না, তাছাড়া ডানে দ্রুত কাত করতে গেলে এক্সিডেন্ট আরও ভয়ংকর হত হয়তো ছিটকে রাস্তার পাশের কোন গাছের সাথে ধাক্কা লাগতো নতুবা পেছনে থেকে আসা কোন গাড়ির চাকার নীচে চলে গেলাম। ভাবার সময়ও খুব কম, হয়তো এক সেকেন্ড মত ছিল। এসব মমেন্টে আমার ডিসিশন দ্রুতই আসে, যতটা পারলাম স্পিড কমিয়ে সাইকেলের যেখানে আঘাত করলে ক্ষয়ক্ষতি কম হতে পারে সেখানে অর্থাৎ পেছনের দিকে আঘাত করলাম।
এরপর শর্টটাইম মেমরি লস, ১ সেকেন্ডের মত, রাস্তার উপরে প্রচন্ড গতিতে আছড়ে পরলাম, হেলমেট পরা অবস্থায় রাস্তার উপরে মাথা প্রচন্ড জোরে আঘাত করলো। আমি জ্ঞান হারাই নাই, কোনরকমে উঠে দারালাম, হেলমেটটা খুললাম (এক সাইড ভেঙ্গে গেছে আঘাতের প্রচন্ডতায়), বাম হাতটা ব্যাথা করছিল। তখনও বুঝতে পারি নাই কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ৬-৭ জন মহিলা এবং ২-৩ জন মানুষ জমা হয়ে গেল। এক্সিডেন্টের পর এভাবে লোক জমা হওয়াটা কারই পছন্দ না, চুরি ছিনতাই এমনকি বাইক ডাকাতির মত ঘটনা ঘটে। আমার এদিক দিয়ে ভাগ্য কিছুটা ভালই বলা যায়, উনারা আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। আমি কোনভাবেই যেতে চাচ্ছিলাম না এবং পিঠ হাত রক্তাক্ত থাকলেও আমি ঠিক আছি সেরকম একটা শো অফ করছিলাম। এরই মধ্যে রাস্তায় পরে থাকা আমার ফোনটা একজন হাতে ধরিয়ে দিলো। আসলে তখনও বুঝে উঠতে পারি নাই ক্ষয়ক্ষতি কতটা।
সবার প্রথমে যেটা মনে হল সাইকেলের ওই বৃদ্ধকে সাহায্য করার ব্যাপারটা, অদ্ভত হলেও এটাই বাস্তবতা যে গাড়ি যে চালাবে দোষ তারই যদিও ওখানে কেউ আমাকে একবারের জন্যও ব্লেম করে নাই এসব ব্যাপারে। সবাই আমাকে হাসপাতালে যেতে বলছিল, আমি বললাম চাচাকে আগে পাঠানোর ব্যাবস্থা করেন, আমি যেহেতু দাড়িয়ে কথা বলতে পারতেছি কয়েক মিনিট পরে গেলে তেমন সমস্যা হবে না। আমার কেন যেন মনেহচ্ছিল তারা আমার পরিপাটি ড্রেসআপ দেখে আমাকে নিয়েই ব্যস্ত কিন্তু গরীব মানুষটাকে নিয়ে কেউ কিছু বলছে না। একজন চাচাকে নিয়ে ভ্যানে উঠলেন আমার মনেহল দায়িত্ব আমারও কিছুটা আছে। আমার ব্যাগ তখনো পিঠে, ভেতরে ম্যাকবুক, ওয়ালেট (পকেটে আটছিল না) এক সেট জামাকাপরসহ আরও কিছু টুকিটাকি। ব্যাগ থেকে ওয়ালেট বের করে সেখান থেকে ৫০০ টাকার একটা নোট আমি চাচার প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য দিলাম উনারা চলে গেলেন।
আমার উদ্দেশ্য ছিল দ্রুত সরে পরা, এক্সডেন্ট এরিয়াতে অনেক সমস্য হয়, পুলিশি হয়রানী, লোকাল মাস্তানদের সমস্যা করাসহ অনেককিছু। আমি বাইকটা রাস্তাথেকে তোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু হাতে শক্তি পাচ্ছিলাম না। একজন সাহায্য করলো, বেশ কয়েকবার ইঞ্জিন চালু করার চেষ্টা করলাম সেলফ স্টার্ট দিয়ে কিন্তু কাজ হচ্ছিল না পরে সম্ভবত কিক করে স্টার্ট করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তাও কাজ হল না। আমি কিছুটা ভয়ই পেয়ে গেলাম এখান থেকে যাবো কিভাবে সেটা নিয়ে। ঘটনাক্রমে একজন মটরসাইকেল মেকার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং ওখানে থাকে একজন ভদ্রলোক (পরে জেনেছি উনি আসলে এলাকার চেয়ারম্যান) তাকে থামালেন এবং বাইকটার সমস্যা দেখতে বললেন, বাইকের ক্ষয়ক্ষতি বলতে বাঙ্কারটা বাঁকা হয়ে গিয়েছে। লাথি দিয়ে উনি ওটা খুলে ফেলে বাইক স্টার্ট করার চেষ্টা করতে লাগলেন, কাত হয়ে রাস্তায় পরে থাকায় মুলত বাইকের তেল উঠে আসছিল যা কয়েকবার ট্রাই করার পর চালু হল। আমাকে বারবার অনুরোধ করার পরও আমি থাকলাম না এবং চলে যাওয়ার জন্য বাইকে উঠলাম, প্লান নেক্সট হাসপাতাল থেকে ক্ষতস্থান ব্যন্ডেজ করিয়ে নিয়ে ঢাকা ব্যাক করবো।
বাম হাতের জয়েন্টে ঘারের কাছাকাছি ব্যাথাটা তখন বেশি লাগছিল আমি বাইকের হ্যান্ডেল ধরে রাখার মত শক্তি পাচ্ছিলাম না, বাইক থেকে নামলাম হাতের প্রতিটা স্থান চেক করছিলাম কোন হার ভাঙ্গছে কিনা এবং তারপর আবিষ্কার করলাম কলার বোন ব্রোকেন! এতটাই হতাশ হয়ে পরেছিলাম যে কয়েকজন আগায় এসে ধরলো। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। বাড়িতে ফোন দেয়ার আইডিয়া প্রথমেই বাদ দেই। মামুন ভাইয়ের কথা মাথায় আসে, উনাকে ফোন দিতেই ভাবী ফোন ধরে, অনেকটা কাদো কাদো অবস্থায় তাকে এক্সিডেন্টের কথা বলি, এরপর মামুন ভাই নিকঠস্ত কোন হাসপাতালে যেতে বললেন দ্রুত আর উনি আসছেন জানালেন।
আমি উনাদের বললাম আমার বাইকটাসহ আমাকে যেন হাসপাতালে পৌছে দেয়। হাসপাতাল মোটামুটি ৫-১০ কিলোমিটার দুরে হবে হয়তো। সেই মটরসাইকেলের মেকার (সম্ভবত উনার নাম বিষ্ণু) আমার বাইকটা চালিয়ে মধুপুর হাসপাতালে নিয়ে আসলেন। আমার অবস্থা তখন এতটাই নাজুক যে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল।
হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে যখন ঢুকছি তখন বাম হাতের ব্যাথাটা মারাত্বক অবস্থা ধারন করেছে, ডান হাত দিয়ে বাম হাত উচু করে রেখেছি। ডান কাধে তখনও কয়েক কেজি ওজনের ব্যাগ। ইমার্জেন্সিতে আমার অবস্থা দেখে তারা কারও সাথে কথা বলে দোতলায় যেতে বললেন, দোতলায় ডক্টর শাহনেওয়াজ নামে একজন বসেন আমি উনার রুমে গেলাম এবংউনি দ্রুত দুটো ইঞ্জেকশন, এক্সরে করতে বললেন, ওয়ালেটে দের দু হাজার টাকা সবসমই রাখার উপকারীতা তখন টের পাওয়া গেল। বিষ্ণু নামের ওই লোকই আমাকে ইঞ্জেকশন এনে দিলো (টাকা অবশ্য আমি দিয়েছিলাম) আমি ততক্ষন বসেছিলাম বেডে। খুব ঘুম ধরছিল তখন কিন্তু অনেক বড় পরীক্ষা দিতে হচ্ছিল তখন, পেইন প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। ইঞ্জেকশন আনার পর নার্স ডেকে আনা হল দেয়ার জন্য, ইঞ্জেকশন দেয়ার পর ডান হাতটা অবশ হয়ে গেল, তখন মনে হচ্ছিল সত্যিই যদি কিছুক্ষন কাঁদা যেত! দুটো হাতই তখন প্রাকটিকেলি ইউজলেস, ডান হাতটা অবশ্য কয়েক মিনিট পরই ঠিক হয়ে গেল, মুলত মাংশপেশীতে ইঞ্জেকশন দেয়ার কারনে এমনটা হয়েছিল।
আব্বু ফোন দিলো নগদে মিথ্যা কথা বললাম, সবকিছুই ঠিক আছে বলে দিলাম, ঢাকা যাবো শিঘ্রই তাও জানালাম। আব্বু নিশ্চিন্তে ফোন রেখে দিলো।
এরপর এক্সরে রুমের সামনে বসে বসে অপেক্ষা করছি কিন্তু উনাদের সচিবালয়ের মত চালচলন দেখে মেজাজ মাথায় উঠার মত, প্রথমে কারেন্ট নেই পরে আসেন তারপর এই কাগজ সই করে আনেন ওটায় সিল মেরে আনেন। ডক্টরকে যেয়ে বললাম এরা সেবা দেয়ার নামে ইগনোর করছে আমাকে অন্যকোথাও রেফার করেন। আমাকে একটি প্রাইভেট ডায়গনাস্টিক সেন্টারে রেফার করা হল। ততক্ষনে মামুন ভাই, কামাল ভাই একটা কার নিয়ে চলে আসলো। এক্সরে করার পর ডক্টরের আসার অপেক্ষা না করে ভাঙ্গা হাত নিয়ে গেলাম চা খাইতে। পেইন কিলারের জন্যই কিনা জানি না, মিস্টি চা খেতে খুবই দারুন লাগছিল।
ডক্টরের দেখা মিললো আসার পর টিশার্টটা খুলে উনি ক্ষতস্থান ড্রেসিং করার জন্য পাশের রুমে নিয়ে গেলেন। ড্রেসিং জিনিসটা নিয়ে আগে সেরকম আইডিয়া ছিল না তবে পত্রিকায় সম্ভবত পরেছিলাম পোড়া রোগীরা ড্রেসিং এর সময় প্রচুর চেচামেচি করে। আমি পোড়া রোগী না তারপরও জিজ্ঞাসা করেই বসলাম, জ্বালাপোরা করবে কিনা। উত্তর আসলো কিছুটা তো করবেই। কিছুটা জ্বালাপোড়া ঠিক কতখানি তারপরই টের পেলাম, ২ ঘন্টা দেরী করে ড্রেসিং করার কারনে পিঠের ক্ষতস্থানে রক্ত শক্ত হয়ে গেছে প্রায় সেখানে “পভিসেফ” ঢালতেই আগুন ধরিয়ে দেয়ার মত অবস্থা হল। যেহেতু এটা তার ভাষায় “অল্প জ্বালাপোড়া” তাই দরদর করে ঘামতে লাগলেও ঠোট কামরানো আর জোরে শ্বাস নেয়া ছাড়া বেশি কিছু করতে পারলাম না। ক্ষতস্থাতে দু যায়গায় গর্তমত হয়ে গিয়েছে সেখানে গজ দিয়ে ডলাডলি করাটা মোটেই সুখকর না এবং পরে জানলাম ড্রেসিং এর সময় সবাই নাকি ভালই চেচামেচি করে, মনে মনে চিন্তা করলাম ব্যাপারটা আগে বললেই তো শান্তিতে চেচাতে পারতাম!!
ঘারের ড্রেসিং শেষ হতেই আম্মা ফোন দিলো, তখন পায়ে আর হাতে বাকি, আবার একগাদা মিথ্যার ফুলঝুরি, আমার মিথ্যা বলার প্রতিভায় আশেপাশের লোকজনের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। গ্রামের লোকগুলো মনেহয় এত আর্ট নিয়ে মিথ্যা বলতে শুনে নাই।
ঘটনাক্রমে সেই সরকারী হাসতপাতালের এক্সরে অপারেটর দেখি এখানে এসে কি করতেছে, ঝাড়ির উপরে ঝাড়ি দিছি, ও ব্যাটা আসলে এত আকস্মিক আক্রমন চিন্তা করে নাই, হাসি হাসি মুখ নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলো তাদের রুলস আগে পেপার সাইন করে আনা এই সেই। আমি বললাম রোগী মরে যাওয়ার সময়ও কি হাতে পেপার ধরিয়ে দেয় কিনা। আমতা আমতা করতে লাগলো, কানের উপরে দুটা দিতে পারলে শান্তি হত। বেশি এগ্রেসিভ না হলেও ভালমত অপমান করছি।
এরপর হাত গলার সাথে ট্রিফোল্ড কাপর দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হল, যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। কামাল ভাই এতক্ষনে বাইক নিয়ে বাঙ্কার লাগিয়ে আনছে, তমাল ভাই বাসে করে উপস্থিত হল। আমি আর মামুন ভাই কারের মধ্যে বসলাম উনারা বাইকে করে রওনা হল। মামুন ভাইয়ের বাসায় এসে শুয়ে শুয়ে প্লান করতেছি পরদিন কিভাবে ঢাকা চলে যাওয়া যায় এক পর্যায়ে চিন্তা করে দেখলাম হাতের এই অবস্থা নিয়ে ঢাকা যেয়ে সুবধা করতে পারবো না, বাপকে ফোন দিয়ে সব বলেই ফেললাম। বাসায় তো তুলকালাম লেগে গেল এবং তখুনি পাবনা চলে আসতে বললো। কামাল ভাই আর তুহিন ভাই মিলে আরেকটা কারে করে আমাকে রাত ১২ টার দিকে পাবনা পৌছাই দিয়ে তারা রাতেই চলে গেল। এখন বসে বসে সুস্থ হওয়ার দিন গুনতেছি!!